কাজল কায়েস: রুপালি মাছ ইলিশ, নারিকেল, সুপারি আর সয়াবিনের জন্য বিখ্যাত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর বরাবরই অবহেলিত, বঞ্চিত। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সড়ক যোগাযোগ, রেল কিংবা শিল্প-কারখানার দিকে কখনোই নজর দেয়নি।
২০ লাখ মানুষের এই জেলায় কৃষিই প্রধান পেশা। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) গঠনের গত সাত বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি বেসরকারি মিলে ৭৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় একটিও নেই। আরো নতুন নতুন আরো অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সেখানেও নাম নেই লক্ষ্মীপুরের। এমন বাস্তবতায় আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই জনপদে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জোর দাবি উঠেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ বলছেন, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে লক্ষ্মীপুরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে মেঘনা উপকূলীয় চরগুলোতে পর্যাপ্ত সরকারি খাস ও ব্যক্তি মালিকানা জমি রয়েছে। লক্ষ্মীপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সব ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সব বৈশিষ্ট্য থাকার পরও জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দৃশমান অগ্রগতি নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র বলছে, লক্ষ্মীপুরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক সায় আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। পিছিয়ে থাকা এই জনপদে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন আছে; কিন্তু অজানা কারণে লক্ষ্মীপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি গভর্নিং বোর্ডের সভায় উঠছে না। যে গভর্নিং বোর্ডের সভার সভাপতি প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মঈনউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠি পাঠানো হয় বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বরাবর। একই চিঠি পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসককে। তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজু চৌধুরীরহাটসংলগ্ন স্থানের সঙ্গে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, পটুয়াখালী পায়রা বন্দর এবং চাঁদপুরের নদীবন্দরের সঙ্গে সড়কপথ ও নৌপথের সংযোগ রয়েছে। সস্থা শ্রমবাজার রয়েছে। মজু চৌধুরীরহাটসংলগ্ন স্থানে বৃহৎ পরিসরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য সব ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং ওই প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী সদয় অনুমোদন করেছেন।’
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লক্ষ্মীপুর জেলার মজু চৌধুরীরহাটসংলগ্ন স্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বেজাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে। চিঠি দেওয়ার পর দুই বছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বেজার কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের যুগ্ম সচিব এস এম নুরুল আলম গত বছর ২৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কয়েকটি স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে তিনি জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাসভায় যোগদান করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বেজার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী মেঘনারপাড়কে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করার জন্য আমরা খাসজমি চেয়েছি। জমির বিষয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে বাস্তবভিত্তিক আশানুরূপ প্রস্তাব পাওয়া যায়নি। সেখানের অধিকাংশ জমি ব্যক্তি মালিকানার। এতে প্রথম পর্যায়ের কাজে সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা সম্ভব হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী খাসজমি পাওয়া গেলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে সেখানে কাজ করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী সারা দেশেই অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য বলেছেন, পর্যায়ক্রম তা করা হবে। এটি সময়ের ব্যাপার।’
লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল একটি জনগুরুত্বপূর্ণ দাবি। এ বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র দিয়েছি। এনিয়ে জেলা প্রশাসকও বিস্তারিত মতামত দাখিল করেছেন।’
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্মীপুরের উন্নয়নে বেশ আন্তরিক। সম্প্রতি তিনি গুরুত্বপূর্ণ ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১৭টি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছি।
সদ্য বিদায় নেওয়া লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) হোমায়রা বলেন, লক্ষ্মীপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। চরাঞ্চলের খাস জমিগুলোর কিছু বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ব্যক্তি মালিকানা জমিগুলোর ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনার বিষয়।
আর্থসামাজিক উন্নয়নে লক্ষ্মীপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা জরুরি
