জুনাইদ আল হাবিব: সমুদ্র তীরবর্তী ৭১০ কিলোমটার তটরেখা। পূর্বে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ, পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর। দক্ষিণাঞ্চলের ১৫টি জেলা প্রত্যক্ষ উপকূল। যেখানে ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা বিদ্যমান। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, মাত্রাধিক বজ্রপাত, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার তীব্র প্রভাবসহ নানান সমস্যায় ক্ষত-বিক্ষত হয় উপকূল।
বিভিন্ন দুর্যোগ অভিশাপ হয়ে আসে উপকূলের জনজীবনে। তবুও অবারিত সম্ভাবনার দুয়ারে উপকূল! সাগর- নদীর মৎস্য সম্পদ, পর্যটন শিল্প, রবি শস্য, লবণ চাষ, শুঁটকি উৎপাদন, চিংড়ি চাষ, কাঁকড়া চাষ, গবাদি পশু পালন, কৃষি শিল্প, সমুদ্র সৈকতের খনিজ আহরণ, সমুদ্র সৈকতের বিশাল নীল জলরাশি, নবায়নযোগ্য বা অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎস প্রভৃতি সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকছে উপকূলকে।মৎস্য সম্পদ: দেশের মৎস্য খাতের আয় সিংহভাগই আসে উপকূল থেকে। যদি ইলিশের কথা বলি। ইতিমধ্যে ইলিশ সম্পদ বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে ঘোষণা পেয়েছে। যা থেকে সরকারের রাজস্ব খাতে কোটি কোটি টাকা জমা হচ্ছে। মনে অবশ্য প্রশ্ন জাগবে এই ইলিশ কোথা থেকে আসে? উত্তরে নিশ্চয় "উপকূল" শব্দটিই উঠে আসবে।
পর্যটন: পর্যটন বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ শিল্প। এর জন্য রয়েছে একটি দিবসও। ২৭ সেপ্টেম্বর "বিশ্ব পর্যটন দিবস"।
আমাদেরদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অগণিত পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ মাত্র কয়েকটি পর্যটন কেবল সরকার কর্তৃক ঘোষিত। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে আরো বহু দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র এখনো অঘোষিত রয়েই গেছে। যেগুলোকে সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হলে দেশের অর্থনীতির চাকা পরিগ্রহ করবে নতুন মোড়কে। উপকূলের প্রতিটি জেলায় ৪-৫টি পর্যটন কেন্দ্রের দেখা মিলে। লক্ষ্মীপুরের উদাহরণ যদি বলি, এখানে মেঘনার কূল ঘেঁষা মতিরহাট, আলেকজান্ডার, মাতাব্বরহাট, রামগতি স্লুইসগেট, মজুচৌধুরীরহাটসহ ছোট-বড় বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্রে নিয়মিত পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় জমে। এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কেবল দেশীয় পর্যটক নয়, বিদেশী পর্যটকদের পদচারণা ঘটে।
এক গবেষণাসূত্রে জানা যায়, কেবল গত বছরেই ১২০ কোটি পর্যটক নিজ নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভ্রমণে বের হন। ধারণা করা হচ্ছে, ২৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮০কোটিতে। তাহলে এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে ইকো ট্যুরিজম খাতের অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। এতে দেশের উন্নয়ন হবে টেকসই, অর্থভান্ডারে স্থান দখল করে নিবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
দ্বীপ বা চর: এ বছরের জুলাইয়ের দিকে খবরের খোঁজে তথ্য সংগ্রহে মধ্য উপকূলের চাঁদপুরের দ্বীপ হাইমচরে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃত, "উপকূল বন্ধু" রফিকুল ইসলাম মন্টু'র সাথে। মেঘনার বুকেই দ্বীপটি জেগে ওঠেছে। ওখানে যে কেবল দুর্যোগ ঝুঁকি আর সমস্যা আছে আবার তাও কিন্তু না। দ্বীপটিকে ঘিরে ডাকছে বিপুল সম্ভাবনা। ধান, গম, ভুট্টা, আঁখ, সয়াবিন, বাদাম, মরিচ, ঢেঁড়স, তরমুজসহ নানান অর্থকরী ফসলের জোগান মিলছে দ্বীপটি থেকে। তাছাড়া, বাস্তুচ্যূত মানুষের ঠাঁই মিলছে ওখানে। আর এসব সম্ভাবনাকে টিকে রাখতে দরকার নীতি-নির্ধারণী মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা। এ দ্বীপের মতোই উপকূলের বিভিন্ন সাগর-নদীর বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য দ্বীপ বা চর সম্ভাবনার নতুন বার্তা নিয়ে আসছে। এতে একদিকে যেমন দেশের ভূখন্ড বড় হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন আঙ্গিকে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে।
লবণ চাষ: সমুদ্রের পানিকে কাজে লাগিয়ে লবণ করা হচ্ছে। এতে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে লবণ চাষ চোখে পড়ে। কক্সবাজারের সমগ্র অঞ্চল আর চট্টগ্রামের কিছু কিছু স্থানে লবণ চাষ লাভজনক। শুঁটকি উৎপাদন: শুঁটকি উৎপাদন উপকূলের প্রতিটি জেলায় কম-বেশি উৎপাদন হচ্ছে। যা বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে দেশের অর্থনীতিতে। যে কোন আকারের মাছ শুঁটকির মাধ্যমে সংরক্ষণ করে তা বাজারজাত করা হয়। ফলে যে কোন মুহুর্তে ওই শুঁটকি রান্নার চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কাঁকড়া চাষ: কাঁকড়া শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বেশ কার্যকর। দেশের অনেক জনপদে এখনো কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে সুন্দরবনকে ঘিরে যে তিনটি জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট সেগুলোতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। রয়েছে কাঁকড়া প্রজনন কেন্দ্রও। চাষীরা নদী থেকে রেণু ও বড় কাঁকড়া সংগ্রহ করেন। বড় কাঁকড়াগুলো বিক্রি করে দেন আর রেণু কাঁকড়াগুলোকে হ্যাচারীতে চাষ করেন। আগে কাঁকড়া রেণু উৎপন্ন করা যেতো না। কিন্তু ইদানিং উন্নত প্রযুক্তির সুবাধে কাঁকড়া রেণু উৎপন্ন করা হচ্ছে। ফলে এসব রেণু একবছর ধরে চাষ করে সফল হন চাষীরা।
চিংড়ি চাষ: এটি মৎস্য খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে সাগরপাড়ের যে অঞ্চল রয়েছে সেগুলোতে চিংড়ি চাষ বেশি হয়। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের টেকনাফ ও মহেশখালী, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলার দক্ষিণাঞ্চলের মনপুরা, খুলনা ও বরিশালের বেশ কিছু স্থানে এ চিংড়ি চাষের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। যা আমাদের দেশীয় অর্থনীতিকে সচল রাখছে।
রবি শস্য: উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষেতগুলোতে বিশেষ করে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। এতে জোয়ারের পানির মাধ্যমে আসা পলি জমিকে বেশ উর্বর করে তোলে। ফলে রবি মৌসুমে সয়াবিন, মরিচ, বাদামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রবি শস্যের বাম্পার ফলন হয়। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর সয়াবিন চাষের জন্য বিখ্যাত। দেশের ৭৫ভাগ সয়াবিনের চাহিদা মেটানো হয় এখান থেকেই। আর মরিচ ও বাদামের উৎপাদন ঘটে বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি উৎপাদনে উপকূলের ভূমিকা কম নয়।
ধান: ধান উৎপাদনের গল্পটার দিকে চোখ ফিরালে আমরা দেখি, বরিশাল, চাঁদপুর, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী থেকেও বছরজুড়ে দেশের খাদ্যদ্রব্যের অন্যতম এ উৎসটি সরবরাহ করা হয়। তবে লক্ষ্মীপুর ও বরিশালে ধান উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কৃষি
শিল্প: মৎস্য চাষ, গবাধি পশুর লালন-পালন ও বিভিন্ন ধরণের কৃষিমূখী ফসল উৎপাদন হচ্ছে উপকূলে। বহু সংকটের মাঝেও এসব সম্ভাবনা এগুচ্ছে দূরন্ত গতিতে। সমুদ্র সৈকতে খনিজ: বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে বিপ্লব ঘটেছে খনিজ সম্পদের। যার মধ্যে ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইল, গারনেট, জিরকন, রুটাইল, মোনাজাইট, ক্যায়নাইট ও লিউকপ্রিন-এর মতো মূল্যবান ভারি খনিজ সম্পদ আছে। এছাড়াও আছে খনিজ বালু। এগুলো আমাদের উপকূলের সম্পদ, দেশের সম্ভাবনা। সমুদ্র সৈকতের খনিজ আহরণ করে দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে বিরাট স্রোত বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পদ। সমুদ্র সৈকতের
জলরাশি: উপকূলের সমুদ্র সৈকতের বিশাল নীল জলরাশি আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। বিদেশ থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও এ সম্ভাবনা দেখে দেশের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা জন্মে। এ বিশাল নীল জলরাশি দেশি-বিদেশী পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে এখান থেকেও আমাদের রাজস্ব খাতে বিরাট একটা আয় মাইল ফলক হয়ে আসবে। নবায়নযোগ্য বা অনবায়নযোগ্য
শক্তি: অনবায়নযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানি তেল, গ্যাস। এগুলোর অধিক অংশ উপকূল থেকে সরবরাহ করা হয়। সম্প্রতি নোয়াখালীর সুবর্ণচরেও গ্যাস কূপের সন্ধান মিলেছে। অন্যদিকে যখন এসব জীবাশ্ম জ্বালানি পুরিয়ে যাবে, তখন আমাদের অবশ্যই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ছুটতে হবে। সেজন্য অবশ্য নতুন আবিষ্কারের কথা বলি যেটা কখনো পুরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যার মধ্যে পানির কার্বাইন ঘুরিয়ে ও উপকূলীয় অঞ্চলের বায়ু প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নবায়নযোগ্য শক্তির এক অফুরন্ত সম্ভাবনা। এজন্য এই সম্ভাবনার জন্য এমন একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যেটি নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা মেটাবে।
প্রিয় পাঠক! এমনই সম্ভাবনার হাতছানি আমাদের উপকূল থেকে উপকূলে। যেটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে করছে অনেক গতিশীল। কিন্তু এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে উপকূল থেকে উপকূলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলতে হবে। সম্ভাবনার সুরক্ষায় উঁচু ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
অপরদিকে নতুন প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হবে এসব সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে। তাদেরকে সচেতন করতে হবে। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনে
হুমকির মুখে আমাদের উপকূল। দিন দিন পরিবেশ দূষণের মাত্রা এতটাই প্রকট রূপ নিচ্ছে, বেঁচে থাকাটাও কষ্টকর। এজন্য সামগ্রিক অর্থে আমাদের সবাইকে কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে উপকূল সুরক্ষার তাগিদে দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এতেই আমাদের সম্ভাবনা নবদিগন্তে পদচারণা করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।